দুবাই কিভাবে এতো ধনী হলো?



১৯৮০ সালের আগে দুবাই শুধুই একটা মরুভূমি ছিল। এখানে না ছিল পানি, না ছিল মানুষ, এমনকি না ছিল একটি বিল্ডিং। অনেকেই বলতো এখানে কখনোই জনবসতি গড়ে তোলা সম্ভব নয়।  

কিন্তু কারো কথাতে কোনরকম কান না দিয়ে দুবাইয়ের শাসক শেখ মোহাম্মদ বিন রশিদ আল মাকতুম মাত্র ৪০ বছরের মধ্যেই দুবাইয়ের পুরো মানচিত্রকেই বদলে দেয়। কিন্তু কিভাবে? চলুন জেনে নেয়া যাক জিওটেল বাংলার আজকের আলোচনা থেকে। 

মোহাম্মদ বিন রশিদ দুবাইকে নিয়ে এমন একটি পরিকল্পনা তৈরী করেন, যা হবে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ, সবচেয়ে বড়। এমন এক শহর যেখানে পৃথিবীর সকল মানুষ ঘুরতে যেতে চাইবে, চাইবে স্থায়ী বসবাস করতে। যা চেয়েছিলেন ঠিক সেটাই করে দেখান তিনি। 

ছবিঃ মোহাম্মদ বিন রশিদ আল-মাখতুম

তিনি দুবাইকে খুব কম সময়ের ব্যবধানে উন্নতির শিখরে পৌঁছে দিয়েছেন। দুবাই এখন পুরো পৃথিবীতে এতটাই বিখ্যাত হয়ে গেছে যে অনেকে একে একটি দেশ মনে করে। কিন্তু তাদের জানা নেই যে, দুবাই আসলে কোন দেশ নয়। দেশ তো দূরের কথা এটি কোন রাজধানীও নয়। এটি সংযুক্ত আরব আমিরাতের একটি শহরমাত্র। সেই শহর যেটি ১৮শ শতাব্দীর গোড়ার দিকে একটি মাছধরার গ্রাম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। আর এখন? এখন পুরো পৃথিবী থেকে দুবাইয়ে অবস্থিত পৃথিবীর সর্বোচ্চ ইমারত বুর্জ খলিফাকে দেখার জন্য মানুষ দুবাই ভ্রমন করে।  কিন্তু দুবাইয়ের নেতা এই বুর্জ খলিফা কে রোজ রোজ দেখে মনে হয় একটু বিরক্তই হয়ে গেছেন। তাইতো, মোহাম্মদ বিন রশিদ বুর্জ খলিফা থেকেও আরো উচু বিল্ডিং তৈরি করার জন্য প্রস্তুতি নিয়েছে যার নাম হবে দুবাই ক্রিক টাওয়ার। যেই দুবাইয়ের কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বিল্ডিং গড়ার রেকর্ড রয়েছে আর সেই দুবাই নিজেই তার রেকর্ড ভাঙার জন্য প্রস্তুতি নিয়েছে। ক্রিক টাওয়ারের আনুমানিক উচ্চতা হবে ৮২৮-১৩০০ মিটার পর্যন্ত। এর কাজ এ বছরেই হয়ে যাওয়ার কথা রয়েছে। কিন্তু করোনাভাইরাস পেনডামিকের কারনে এর কাজ আপাতত স্থগিত করা হয়েছে। উল্লেখ্য যে বর্তমানে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বিল্ডিং দুবাইয়ে অবস্থিত বুর্জ খলিফার উচ্চতা ৮২৮ মিটার। 

দুবাই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় কনস্ট্রাকশন সাইট, যার উন্নতির গতি সবচেয়ে বেশি বলে মনে করা হয়। ১৯৮০ সাল পর্যন্ত দুবাই শুধুই মরুভূমি ছিল কিন্তু তারপরে আমিরাত হঠাত করেই দুবাইয়ে তেলের সন্ধান খুজে পায় যা দুবাইয়ের চেহারাকে একেবারের জন্য বদলে দেয়। দুবাইয়ে তেলের সন্ধান পাওয়ার পর, এখানে মোহাম্মদ বিন রশিদ খুব বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দেন।  তিনি বুঝতে পারেন দুবাই শুধু তেলের উপর নির্ভর করে থাকতে পারে না। তাই তিনি তেলের উপর নির্ভরতাকে দূর করে দুবাইয়ের এমন একটি পরিকল্পনা মানচিত্র তৈরি করেন যা পর্যটক ও ব্যবসায়ীদেরকে আকর্ষণীয় করে তোলে। 

আর আজ দুবাই তার অর্থনৈতিক জিডিপির মাত্র ৫% তেলের উপর নির্ভর করছে। বর্তমানে এখানকার অর্থনীতির ৯৫% আসে পর্যটক, বানিজ্য কর, এয়ারলাইন্স, রিয়েল এস্টেট ইত্যাদি থেকে। আর এখন তো দুবাই পৃথিবীর সবথেকে বড় বিজনেস ও ট্রেডিং হাবও হয়ে গিয়েছে। 

একসময়ে এসে মোহাম্মদ বিন রশিদ দুবাইকে সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেন। সহজ করে দেন দুবাইয়ের নাগরিকত্বকে। এখানে পৃথিবীর যেকোন স্থান থেকে এসে মানুষ এপার্টমেন্ট কিনতে পারবে, বিজনেস করতে পারবে এবং পারবে বিল্ডিং তৈরী করতে। এরপর তিনি আরো আশ্চর্যজনক যে কাজটি করেন সেটি হচ্ছে, দুবাইকে সকল ধর্ম বর্ণ সবার জন্য ইকুয়াল করে দেন। আপনি জানেন যে, দুবাই একটি ইসলামিক স্টেট। কিন্তু এখন এখানে সকল ধর্মের লোক স্বাধীনভাবে ধর্ম পালন করতে পারে। খ্রিষ্টানরা চার্চ তৈরী করতে পারবে, হিন্দুরা তৈরী করতে পারবে মন্দির। তাই, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে মানুষ দুবাইয়ে গিয়ে থাকতে শুরু করে। আর আজ দুবাই এমন একটি ইন্টারনেশনাল সিটিতে রুপান্তরিত হয় যার মোট জনসংখ্যার ৮৫%ই বিদেশী। যারা দুবাইতে কাজ করতে এবং থাকতে যায়। প্রবাসী জনসংখ্যার ৭৯ শতাংশই ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ এবং ফিলিপাইনের অধিবাসী। 

১৯৯০ সালে দুবাইতে শুধু একটাই উঁচু বিল্ডিং ছিল। যার নাম ছিল দুবাই ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার। আর আজ দুবাইতে মোট ৯৭০টি উচু বিল্ডিং আছে, যাদের কথোপকথন শুধুই মেঘের সাথে। 

দুবাইয়ের নাগরিকদের বিলাসী জীবনযাপনের খাতিরে যেমন সুপারকার ব্যবহার করতে হয়। তাই এসব বিলাসী ক্রিমিনালদের পাকড়াও করতেও ব্যবহার করা হয় সুপার পুলিসকার। তাই দুবাই পুলিশ সাধারণ কোনো ভেহিকল ব্যবহার করে না। দুবাইয়ের পুলিশ ডিপার্টমেন্ট রয়েছে সুপারকারে ভরপুর। এদের মধ্যে অস্টোন মার্টিন, অডি, বেন্টলি জিটি আর ল্যাম্বরগিনি উল্লেখযোগ্য। যদি শপিং মলের কথা বলা হয়, তবে দুবাই মল পৃথিবীর সবচেয়ে বড় শপিং মল। যেখানে মোট ১২০০টি বিলাসবহুল দোকান রয়েছে।  

পাম জুমেইরা মনুষ্য নির্মিত অত্যাধুনিক একটি দ্বীপ যা দুবাইতে অবস্থিত। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় হোটেল বিল্ডিং এবং একমাত্র সেভেন স্টার হোটেল বুর্জ আল আরব।  যার অবস্থানও দুবাইতেই। 

একবার, দুবাইয়ের শাসক মোহাম্মদ বিন রশিদ চেয়েছিলেন দুবাইতে আমেরিকার মতো একটি ডিজনিল্যান্ড পার্ক তৈরী করবেন।  কিন্তু তার অনুরোধ ডিজনিল্যান্ডের পক্ষ থেকে ক্যান্সেল করে দেওয়া হয়। হয়ত তারই প্রতিশোধে মোহাম্মদ বিন রশিদ দুবাইতে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় পার্ক তৈরি করে দেখান, যেখানে একসাথে ২০হাজার মানুষ এনজয় করতে পারবে। 

আমরা সাইন্স ফিকশন মুভিতে যে ফিউচারিস্টিক সিটির কল্পনা করি, তা আজ দুবাইতেই বর্তমান। দুবাইয়ের ফিউচার প্রজেক্টগুলোর মধ্যে রয়েছে দুবাই ক্রিক টাওয়ার যেটার কথা একটু আগেই বলেছি।  এরপরে রয়েছে ডাইনামিক টাওয়ার। এতো উচু উচু বিল্ডিং তো অনেক হলো। এসব দেখতে দেখতে মানুষ একদিন না একদিন বিরক্ত হয়েই যাবে। তাই এবার দুবাই এমন বিল্ডিং তৈরীর পরিকল্পনা করেছে যার ফ্লোরগুলো সবসময় ঘুরতে থাকবে। এর ভেতর থেকে আপনি চাইলে এক চলন্ত পৃথিবীকে দেখতে পাবেন। মিউজিয়াম অফ দ্যা ফিউচার। যেখানে থাকবে রোবট, রোবটিক্স কার, রোবটিক মোটরসাইকেল, ড্রোন ইত্যাদি। ১২০০ কিমি প্রতি ঘন্টায় চলতে সক্ষন বিশেষ ক্যাপসুল ভেহিকল হাইপারলুপ যার গতি হবে বিমানের থেকেও অনেক বেশি। আলাদিন ও সিন্দবাদের গল্প থেকে ইন্সপায়ার্ড হয়ে তৈরী হবে রূপকথার শহর আলাদিন সিটি, মনুষ্যনির্মিত আরেকটি আইল্যান্ড যা বর্তমানের জুমেইরা আইল্যান্ড থেকে আরো বৃহৎ আকারের হবে। এছাড়া হচ্ছে ২৫০ মিটার উঁচু পৃথিবীর সবচেয়ে বড় নাগরদোলা যেটি দ্বারা ১৪০০ মানুষ একসাথে দুবাইয়ের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবে। এই নাগোরদোলাটি ইতিমধ্যে তৈরী হয়ে গিয়েছে। এখন শুধু এর উদ্ভোধনের পালা। 

এইসব দেখে একটা জিনিস তো আপনি বুঝতে পেরেছেন, মাত্র ৪০ বছরের ব্যবধানে খা খা মরুভূমির প্রান্তরে কিভাবে পৃথিবীর অন্যতম বিলাসবহুল নগরে পরিণত হয়েছে দুবাই। আসলে কেউ যদি আপনাকে বলে এটা অসম্ভব, তাহলে আপনি সঠিক পরিকল্পনা ও কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে একে ভুল প্রমান করে, সকল অসম্ভবকেই করে তুলতে পারেন সম্ভব। 

আমাদের ভারত ও বাংলাদেশের সরকারেরও উচিত দেশ ও জনগনের উন্নতির কথা মাথায় রেখে, নিজেদেরকে বিশ্ব-দরবারে আইকন হিসেবে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করা। স্বপ্ন, সাহস, আর বাস্তবায়নের দৃঢ় সংকল্প থাকলে আমাদের পক্ষেও সকল অসম্ভবকে সম্ভব করা কঠিন কিছু নয়।