কি হবে যদি পৃথিবীতে একটানা একবছর ধরে বৃষ্টি হতে থাকে?


আপনি কিভাবে এমন কোন শহরে থাকবেন যেখানে একটানা ২৪৭ দিন ধরে বৃষ্টি হচ্ছে? অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে এটা আমাদের এই পৃথিবীতেই হয়েছিল এবং এই মুষলধারে বৃষ্টি আট মাসেরও বেশি সময় ধরে স্থায়ী হয়েছিল!

হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জে এমনই একটি আবহাওয়ার রেকর্ড করা হয়েছে। 

এই ব্যাপারটি যে শুধুমাত্র বিরক্তিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে তা নয়, বরং এটি মানুষের ইউমিউনো সিস্টেম এবং অর্থনীতির বিড়াট ক্ষতি সাধন করে। 

কি হবে যদি আমাদের এই পৃথিবী নামক গ্রহে ধারাবাহিকভাবে বৃষ্টি হতে থাকে এবং এটা কি আমাদের জন্যে ভয়াবহ পরিণতি নিয়ে আসতে পারে? 

হাওয়াই দীপপুঞ্জ। এটা শুধুমাত্র একটা জনপ্রিয় ট্রপিক্যাল রিসোর্টই নয় বরং এটি এই পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হওয়া স্থানগুলোর মধ্যে একটি। ক্রান্তীয় বৃষ্টিপাতের পর আপনি প্রায়শই এর মনোরম প্রাকৃতিক ঘটনাটি পর্যবেক্ষণ করতে পারবেন এই হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জে। হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের অন্তর্গত ওয়াহুতে ১৯৯৩ থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত একটানা ২৪৭ দিন পর্যন্ত বৃষ্টি হয়েছিল।

তবে এই একটানা বৃষ্টিপাত যে কেবল সতেজতা ও ওই এলাকার বাসিন্দাদের বৃষ্টিপাতের প্রশংসা করার সুযোগ এনে দেয়, তা কিন্তু না। 

আবহাওয়ার ধ্বংসাত্মক বন্যার কারণে প্রায়শই সেখানে ঘটে যায় উদাহরণস্বরূপ বিভিন্ন ঘটনা। ২০১৮ এর এপ্রিল মাসে এক হাজার তিনশো আশি মিলিমিটার বা ৫৪ ইঞ্চিরও বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছিল ওই এলাকায়। ফলে ভয়ঙ্কর ভয়ঙ্কর সব বজ্রপাতের সম্মুখীন হয় ওখানকার মানুষেরা। অনেক ফসলি জমি, রাস্তা এমনকি ঘরবাড়িগুলোও পানির নীচে ডুবে যায়। মাটি ভেঙ্গে ঘরবাড়ীগুলো পানিতে তলিয়ে যায়, গাছপালা উপড়ে যায় এবং গাড়ীগুলো উল্টে পানিতে ভাসতে থাকে।

ঘূর্ণিঝড়ের মূল শক্তিটি কয়েক ঘন্টা স্থায়ী হয়েছিল তবুও এই সময়ের মধ্যে প্রায় ১২৫ মিলিয়ন ইউ.এস ডলার সমপরিমাণ ক্ষতি হয়েছিল। এরকম অতিবৃষ্টির ফলে পৃথিবীর অনেক অঞ্চলে অনেক ঘটনা ঘটতে দেখা যায়। 

একবার নেদারল্যান্ডের ৪ ভাগের ১ অংশই পানির নিচে ডুবন্ত ছিল। তারা এর প্রতিরোধের জন্য বড় আকারের ড্যাম বা বাধও তৈরী করেছিল। তবুও যদি এই বৃষ্টিপাত কন্টিনিউয়াসলি চলতো তাহলে পুরো নেদারল্যান্ডের সমুদ্রে তলিয়ে যাওয়া কোন অসম্ভব ব্যাপার ছিল না।

এর আগে ২০০২ সালে ইউরোপেও এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। তখন রাশিয়া, শ্লোভাকিয়া, অস্ট্রিয়াসহ ইউরোপের অনেকগুলো দেশে রেকর্ড পরিমান বৃষ্টিপাতের ঘটনা ঘটেছিল। বিগত ১০০ বছরেও ইউরোপে এতো পরিমাণ বৃষ্টিপাত হওয়ার ঘটনা ঘটেনি। এর ফলে বিল্ডিং ও বেজমেন্টগুলি প্লাবিত হয়, নদীর পানি উপচে যায় এমনকি সাবওয়ে স্টেশনগুলোও পানিতে ডুবে যায়।

মাত্র ১ সপ্তাহের এই টানা বৃষ্টিতে ইউরোপের এই দেশগুলোতে ১৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

অতিবৃষ্টির ফলে পাহাড়ি অঞ্চলগুলোতেও কিন্তু অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে। অধিক বৃষ্টিপাতের ফলে ঝরনা থেকে পানি বেয়ে নদীতে পড়ে এবং নদীর পানির পরিমান বহুগুন বেড়ে যায়। যার ফলে আশেপাশের এলাকাগুলোও প্লাবিত হতে থাকে এবং নদীর দুপাশের সকল বাড়িঘর গাছপালা ১০-১৫মিটার বা ৩০-২৫০ ফিট পার সেকেন্ড গতিতে পানির সঙ্গে ভাসিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা রাখে।

অধিকাংশ সময়ই লোকেরা এইসব বিপর্যয় থেকে পালানো বা নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নেয়ার সময়টুকুও পায়না। উদাহরণস্বরূপ ২০১৮ সালে এরকম পরিস্থিতিতে প্রায় ১৩ জন লোক মারা গিয়েছিল এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া রাজ্যে একটা বড় ভুমিধ্বসের ঘটনাও ঘটে। এর ফলে সৃষ্ট কাদা স্রোত দেখে পুলিশ ও উদ্ধারকর্মী বাহিনীরা রীতিমতো হতভম্ব হয়ে যায়। এমনকি পুরো বিশ্বেজুড়ে যদি এমন অবস্থার সৃষ্টি নাও হয়, যদি পার্টিকুলারলি ওই একটি এলাকাতেই এই সমস্যা ক্রিয়েট হয়, তাহলেও  মানুষদেরও বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখিন হতে হবে। জলাবদ্ধতার কারনে তারা খাদ্য উতপাদনে ব্যর্থ হবে, গাছের একাংশ পানিতে ডুবে থাকবে বলে গাছ প্রয়োজনীয় কার্বন-ডাই-অক্সাইড উতপাদনে ব্যর্থ হবে। তাই গাছগুলো মরতে শুরু করবে। গাছগুলো মরে গেলে মানুষেরাও অক্সিজেনের ঘাটতি অনুভব করবে। এতে মানুষের নিঃশ্বাস প্রশ্বাসজনিত অনেক সমস্যার সৃষ্টি হবে। বিজ্ঞানীদের মতে বিশ্বের প্রায় ১০% কৃষজমি রয়েছে বন্যাপ্রবন অঞ্চলে যার ফলে ফসলের ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

এটা অনুমান করা হয় যে, পুরো পৃথিবী জুড়ে যদি কন্সটেন্টলি ১দিন বৃষ্টি হতে থাকে তাহলে বিশ্বে ফসলের ফলন ২% কমে যাবে আর এটা চলতে থাকলে ক্ষুদার সমস্যা হয়ে যাবে মানবজাতির জন্য প্রধান হুমকি। 

অবশেষে একটানা বৃষ্টিপাত এবং স্যাঁতসেতে অবস্থার ফলে যে মানুষ শুধু বিরক্ত এবং ডিপ্রেসডই হবে তা কিন্তু নয়, বরং গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যার হুমকিতে পরবে অনেকে। উদাহরণস্বরূপ বলতে পারি মারাত্মক সংক্রামক রোগ ম্যালেরিয়ার কথা। ২০১৮ সালে এই রোগে ২২৮ মিলিয়ন মানুষ আক্রান্ত হয়ে প্রায় ৪ লক্ষ ৫ হাজার মানুষ মারা যায়। মশার কামড় দ্বারা এটি একজনের দেহ থেকে অন্য দেহ সংক্রমিত হয়। আর এই পতঙ্গটি কিন্তু এখন বিশ্বব্যাপিই বসবাস করে। ২০১৯ সাল পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা ম্যালেরিয়ার কোন ভ্যাক্সিন খুজে পাননি। ২০২০ সালে একটি ড্রাগের ক্লিনিকাল ট্রায়ালগুলির মধ্যে বিদ্যমান ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা কেবল ৩১ থেকে ৫৬% এর মধ্যে ছিল।

কেনিয়া ঘানা এবং মালাউইয়ের সরকার স্থানীয় জনগণের টিকা দেওয়ার জন্য একটি পাইলট প্রোগ্রাম চালু করে তবুও বিশ্বের এই বিপজ্জনক রোগ প্রতিরোধের একমাত্র উপায় মশা নিধন। আর এই মশাদের সংখ্যা বৃষ্টিপাতের পরিমাণের সাথে সরাসরি সম্পর্কিত।

সুতরাং দেখা যাচ্ছে একটি উষ্ণ আর্দ্র জলবায়ু এবং জলাভূমির উপস্থিতিও একটি মহামারী হওয়ার ঝুঁকি বহুগুণে বাড়িয়ে তোলে। এবং এই ব্যাপারটি দন্ডায়মান হয়েছে আরেকটি মারাত্মক রোগ ডাং ফিভারের কারনে। পানযোগ্য জলের অভাব ও আশেপাশের নর্দমাগুলো দূষিত থাকায় কলেরার মতো মারাত্মক মহামারীর সৃষ্টি হতে পারে। এই কলেরা সংক্রমনটি অ্যানেরোবিক ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সৃষ্ট এবং এই ব্যাকটেরিয়াটি সাধারণত বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলের জলে বাস করে। যেহেতু বন্যা দূর্গত জায়গাগুলোতে বিশুদ্ধ পানির অভাব থাকে তাই ওই অঞ্চলের মানুষেরা নদীর পানি থেকেই পানীয়জলের চাহিদা পূরণ করে। তাই তারা এই ব্যাকটেরিয়া দ্বারা আক্রান্ত হয়ে সহজেই কলেরা রোগগ্রস্ত হয়ে পড়ে। উদাহরণস্বরূপ যদি খেয়াল করি দেখি, তাহলে দেখতে পাবো যে আফ্রিকার ইতিহাসে সবচেয়ে শক্তিশালী সাইক্লোনের কবলে পড়ে হাজার হাজার লোক গৃহহীন হয়ে পড়েছিল। এবং বিশুদ্ধ পানীয় জলের অভাবে অনেক মানুষই মারা গিয়েছিলেন। সেই সাথে ২০১০ সালের অক্টোবরে হাইতিতে 14শোরও বেশি কলেরার ঘটনা রেকর্ড করা হয়। ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১১ তে হাইতির স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয়ের দেয়া তথ্য অনুযায়ী ওই ঘটনায় ৪৫৪৯ জন মারা গিয়েছিল এবং সংক্রমিত হয়েছিল প্রায় ২ লক্ষ ৩১ হাজার জন।

আমেরিকান ও ভারতীয় বিজ্ঞানীদের একটি যৌথ সমীক্ষায় দেখা গেছে যে একটানা দীর্ঘসময় ধরে ভারী বৃষ্টিপাতের ফলে শিশুদের মধ্যে ডায়রিয়ার প্রকোপ উল্লেখযোগ্যভাবে হাড়ে বেড়ে গিয়েছে। এই সমস্যাটি এখনো ভারত বাংলাদেশে একটি সাধারণ সমস্যা। গ্রীষ্মকালে সাধারণত এই দেশগুলোতে এমন সমস্যার মুখে পড়তে হয়।

গবেষকরা শিশুদের ডায়রিয়া হওয়ার ব্যাপারটি বৃষ্টিপাতের পরিমাণের সাথে তুলনা করেন। দেখা গেছে এ ধরনের বন্যার কয়েকদিনের ভেতরেই শিশুরা রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ে এবং তিন সপ্তাহ মধ্যে এই রোগাক্রান্ত শিশুর সংখ্যা ৩গুণ বেড়ে যায়। আবার এদিকে দীর্ঘ শুকনো পরিবেশের সময় যদি বৃষ্টি হওয়া শুরু হয় তাহলে দেখা যায় যে, প্রথম দিনের তুলনায় বৃষ্টির পরিমান ২.৬ গুন বেড়ে যায়। আমার জানা নেই বন্যার সময় চিকিত্সকরা এতগুলি রোগকে সামাল দিতে পারেন কিনা। 

সত্যিকার অর্থে ক্রমাগত বৃষ্টিপাতের পরিণতি মানবসমাজকে বিপর্যয়ের দিকেই ঠেলে দেয়। কিন্তু এটা কি হতে পারে যে পুরো পৃথিবী হঠাৎ প্লাবিত হয়ে গেছে? বিজ্ঞানীদের গবেষণা অনুসারে, তারা নিশ্চিত করেছেন যে এমন ঘটনা আপাতত আমাদের পৃথিবীতে ঘটবে না। 

মোট বায়ুমণ্ডলীয় জলের পরিমাণ তেরো ট্রিলিয়ন কিউবিক মিটার। সেই সাথে আমাদের গ্রহের পৃষ্ঠতল এরিয়া ৫১০.০৭২ মিলিয়ন স্কয়ার কিলোমিটার বা প্রায় ১৯৭ মিলিয়ন স্কয়ার মাইল। এমনকি যদি আপনি কল্পনা করেন যে এই সমস্ত আর্দ্র বা জলের কণাগুলো হঠাৎ করে পৃথিবীর পৃষ্ঠে সমানভাবে পড়ছে তবে এর পুরুত্ব মাত্র ২৫.৩ মিলিমিটার বা এক ইঞ্চি হবে। উদাহরণস্বরূপ, ভারী বৃষ্টিপাতের সময় প্রতি ঘন্টায় ৮ মিলিমিটার বা ০.৩ ইঞ্চি জলকণা মাটিতে পড়ে। সুতরাং যদি বিশ্বব্যাপী প্লাবন সংঘটিত হয় তবে এই বৃষ্টিপাত মাত্র ৩ ঘন্টা পর্যন্ত স্থায়ী হবে। তারমানে আমাদের এটা ভাবলে চলবে না যে বায়ুমন্ডল থেকে সকল আর্দ্রতা নিঃশেষ হয়ে গিয়েছে কারণ পৃথিবীতে গড় তাপমাত্রা বাড়ার সাথে সাথে বৃষ্টিপাতের পরিমাণও বৃদ্ধি পেতে থাকবে। কিন্তু কখনো জলবায়ুর এমন পরিবর্তন ঘটলে আমাদের জন্য যে বিপর্যয় ডেকে আনবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তাই, আমরা সেই দিনটি যদি না দেখতে চাই যেদিন পুরো পৃথিবীতে কনটনিউয়াসলি বৃষ্টিপাত হতে থাকবে, তাহলে এখন থেকেই আমাদের পরিবেশের ওপর যত্ন নেওয়া উচিত।