কুখ্যাত গোয়েন্দা সংস্থা ইসরায়েলের মোসাদ
১৯৫১ সালের মার্চ মাসে ইসরাইলের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ডেভিড বেন গুরিয়ান মোসাদ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৫১ সালে প্রতিষ্ঠা হলেও এর কার্যক্রম শুরু হয় ১৯৪৯ সালের ১৩ ডিসেম্বর থেকে। প্রধানমন্ত্রী বেন গুরিয়ান মনে করতেন গোয়েন্দাবৃত্তি ইসরাইলের প্রধান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। মোসাদ ইসরাইলের প্রধান গোয়েন্দা সংস্থা। টার্গেট দেশ থেকে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ এবং এর রিপোর্ট ও তথ্য সরাসরি ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রীকে দিতে হয়। খেয়াল করে দেখবেন যে, অন্যান্য সংস্থাগুলোর তুলনায় মোসাদ অবিশ্বাস্যরকম ছোট, এর আনুমানিক সদস্যসংখ্যা ১২০০ জন, যেখানে সমমানের গোয়েন্দা সংস্থা, আমেরিকার সিআইএ এর সদস্যসংখ্যা প্রায় 20,000। যদিও মোসাদ কোন সামরিক সার্ভিস নয় তবুও এর অধিকাংশ কর্মকর্তাই ইসরায়েল ডিফেন্স ফোর্সের।
মোসাদ বিদেশে যে কর্মকান্ড সম্পাদন করে তার মধ্যে একটি হচ্ছে, ইহুদি শরণার্থীদের ইসরাইলে আসতে সহায়তা করা। তাদের এ কাজকে বলা হয় আলিয়া। বিশেষ করে সিরিয়া, ইরান এবং ইথিওপিয়ার মতো প্রতিকূল বা যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলো থেকে মোসাদ এজেন্ট এর মাধ্যমে ইহুদিদের ইসরায়েলে আনতে সহায়তা করতে দেখা যায়।
“ইসরাইলের নিরাপত্তা” প্রশ্নে বিভিন্ন প্রচেষ্টা ও কর্মকাণ্ড মোসাদকে গোয়েন্দা বৃত্তিতে সর্বোচ্চ মর্যাদা দিয়েছে। ইসরাইল প্রসঙ্গে বিতর্কিত বা রাজনৈতিক প্রশ্ন নিয়ে দীর্ঘস্থায়ী বাদানুবাদ তৈরি হলে এ সংস্থা তার কর্মীদের ওই ব্যক্তি বা সংশ্লিষ্ট কাউকে অপহরণ বা হত্যা পর্যন্ত করে থাকে। এসবের পাশাপাশি মোসাদের বিরুদ্ধে নিয়মিত বিচার বহির্ভূত হত্যার অভিযোগও রয়েছে।
চলুন মোসাদের কিছু কর্মকান্ডের চিত্র তুলে ধরা যাক।
অনেক দিন থেকে ইহুদি হত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত নাৎসি বাহিনীর লেফটেন্যান্ট কর্নেল এডলফ ইচম্যানকে খোজছিল মোসাদ। ১৯৬০ সালে আর্জেন্টিনায় তার খোঁজ পাওয়া যায়। ওই বছরের ১১ মে মোসাদের এজেন্টদের একদল টিম তাকে গোপনে আটক করে ইসরাইল নিয়ে আসে। তার বিরুদ্ধে উত্তর ইউরোপে ক্যাম্প গঠন ও পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপ করে ইহুদিদের হত্যার অভিযোগ আনা হয়। ইসরাইলের আদালতে একটি সাজানো বিচারের মাধ্যমে তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়।
১৯৬৫ সালে নাৎসি ওয়ারে অভিযুক্ত লাটভিয়ার পাইলট হার্বার্টস কুকার্সকে উরুগুয়ে থেকে ফ্রান্স হয়ে ব্রাজিল যাওয়ার পথে মোসাদের এজেন্টরা হত্যা করে।
১৯৬০ সালে ফ্রান্সের মিরেজ ফাইভ জেট বিমানের প্রযুক্তিগত বিভিন্ন দলিল চুরি করে নেয় মোসাদ। পরে ইসরাইল ওই প্রযুক্তিকে আরো উন্নত ও যেকোনো আবহাওয়ার উপযোগী করে জে-৭৯ নামের ইলেক্ট্রিক টার্বোজেট ইঞ্জিন তৈরি করে।
১৯৬৮ সালে ইসরাইলের একটি শিপে ২০০টন ইউরেনিয়াম অক্সাইড সরবরাহ করতে একটি কার্গো বিমান যাত্রা শুরু করেছিল। জার্মানি কিছু বুঝে ওঠার আগেই বিমানটি তাদের রাডারের বাইরে চলে যায়। পরে তুরস্কের একটি পোর্টের রাডারে এটি ধরা পড়লে ওই কার্গো বিমান থেকে বলা হয় পথ হারিয়ে তারা এ দিকে চলে এসেছে ও তাদের জ্বালানি ফুরিয়ে গেছে। গালফ থেকে জ্বালানি নিয়ে তারা আবার ফিরে যাবে। পরে তারা নিরাপদে ওই ইউরেনিয়াম অক্সাইড ইসরাইলের একটি শিপে খালাস করে।
১৯৭২ সালে মোসাদ জার্মানির বিভিন্ন উল্লেখযোগ্য ব্যক্তির কাছে পত্রবোমা পাঠায়। যাতে চিঠি খুললেই বোমা ফুটে সে লোক মারা যায়। অবশ্য মোসাদের এ প্রচেষ্টা জানাজানি হয়ে যায় এবং ব্যর্থ হয়।
১৯৬৯ সালের ১৯ জুলাই মিসরের ছোট দ্বীপ গ্রিন আইল্যান্ডে ইসরাইল ডিফেন্স ফোর্স আকস্মিক হামলা চালায়। মোসাদ এই অভিযানের নাম দেয় অপারেশন বালমাস সিক্স।
পরবর্তী সময়ে অনেক ইসরাইলি ইহুদি ও পর্যটকরা সিনাই হতে মিসর আসে অবকাশ যাপনের জন্য। মোসাদ নিয়মিত এসব পর্যটকের নিরাপত্তা দেখভালের জন্য গোয়েন্দা পাঠাত। ধারণা করা হয় এরই ধারাবাহিকতায় ২০০৬ সালে ২য় লেবানন যুদ্ধ সঙ্ঘটিত হয়।
ইসরাইল ইরানকে বরাবরের মতোই বড় ধরনের হুমকি মনে করে। মোসাদ মনে করে খুব শীঘ্রই ইরান পারমাণবিক শক্তিধর দেশে পরিণত হয়ে যাবে। সম্প্রতি মোসাদের ডিরেক্টর মীর দাগান তার এক বক্তৃতায় এ কথা স্বীকারও করেছেন। ফলে মোসাদের তৎপরতা ইরানে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। সিআইএ এ কাজে মোসাদকে সহযোগিতাও করছে। তাই ২০০৭ সালের ১৫ জানুয়ারি ইরানের পরমাণু বিজ্ঞানী ড. আরদেশির হোসেনপুরকে হত্যা করে মোসাদ।
১৯৬৬ সালে জঙ্গি বিমানের পাইলট খিষ্টান বংশোদ্ভূত মুনির রিদফাকে বিমানসহ কৌশলে ইরাক থেকে ইসরাইল নিয়ে আসে মোসাদ। তার কাছ থেকে ইরাকের সকল গোপন তথ্য সংগ্রহ করা হয় এবং তা ব্যবহার করা হয় ইরাকবিরোধী প্রচারণায়। এরপরে সংবাদ সম্মেলন করে ইরাকে খ্রিষ্টান নিধনের প্রচারণাও চালায় মোসাদ।
১৯৭৮ থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত ইরাকের অসরিক নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টরের স্পর্শকাতর কিছু গোপন বিষয়ে গোয়েন্দা তৎপরতা চালায় মোসাদ। এই অপারেশনের নাম দেয়া হয় অপারেশন স্ফিঙ্কএক্স। ইরাক এই গবেষণা সম্পন্ন করতে পারলে পারমাণবিক গবেষণায় বিশ্বের যেকোনো দেশের চেয়ে এগিয়ে থাকত। মোসাদ মনে করেছিল এখনই যদি এই প্রোগ্রাম ধ্বংস করা না হয় তাহলে শিগগিরই ইরাক পারমাণবিক শক্তিধর হয়ে যাবে। এ জন্য ১৯৮১ সালের ১৭ জুন এফ-১৬ যুদ্ধ বিমানে বিপুল গোলাবারুদসহ একটি ইউনিটকে পাঠানো হয় ইরাকের এই প্রকল্প ধ্বংস করে দেয়ার জন্য। ইরাক কিছু বুঝে ওঠার আগেই বোমা হামলা করে অসরিক নিউকিয়ার রিঅ্যাক্টরের ব্যাপক ক্ষতি করে। ইরাক পরে আর এ প্রকল্পটি নিয়ে আগাতে পারেনি। এই হামলাটি অপারেশন অপেরা নামে পরিচিত।
কানাডার বিজ্ঞানী গিরাল্ড বুল বিভিন্ন দেশে স্যাটেলাইট গবেষণায় কাজ করতেন। ইরাক স্যাটেলাইট উন্নয়ন প্রোগ্রাম ‘প্রজেক্ট ব্যাবিলন’-এর ডিজাইন করলে তাকে ১৯৯০ সালের ২২ মার্চ বেলজিয়ামের ব্রাসেলসে তার বাড়ির বাইরে গুলি করে হত্যা করে মোসাদ।
ইসরাইলের পারমানবিক প্রোগ্রামের গোপন তথ্য ব্রিটেনে পাচার করার কারণে ১৯৮৬ সালে ইতালির রাজধানী রোম থেকে ইসরাইলের নাগরিক মোডাচাই ভ্যানুনুকে অপহরণ করে ইসরাইল নিয়ে আসে মোসাদ। পরে তাকে জেলে ঢুকানো হয়।
মিউনিখ গণহত্যায় অভিযুক্ত ইসারাইলের নাম দেয়া ব্লাক সেপ্টেম্বরের সদস্যদের, ১৯৭২ সালে ফিলিস্তিনে হত্যা করা হয়। এই অপারেশনের নাম দেয়া হয় অপারেশন র্যাথ অব গড।
১৯৭৩ সালের জুলাইয়ে নিরপরাধ আহমেদ বৌচিকি কে তার গর্ভবতী স্ত্রীর সাথে হাঁটার সময় হত্যা করা হয়। তাকে ব্লাক সেপ্টেম্বরের অভিযুক্ত আলী হোসেন এর আশ্রয়দাতা মনে করা হয়েছিল।
১৯৭৮ সালে হত্যা করা হয় পপুলার ফ্রন্ট ফর দ্য লিবারেশন অব প্যালেস্টাইন নেতা ওয়াদি সাদাদকে।
১৯৭৯ সালে হত্যা করা হয় পিএলও’র আসসাদিকা নেতা জুহাইর মুহসিনকে।
ফাতাহ নেতা আবু জিহাদকে ১৯৮৮ সালে হত্যা করে টুনিস রেইড নামের ইসরাইল ডিফেন্স ফোর্সের এক সদস্য।
ফিলিস্তিনের ইসলামি জিহাদ নেতা ফাতহি শাকাকিকে হত্যা করা হয় ১৯৯৫ সালে।
১৯৯৭ সালে আম্মানে হামাসের এক সহযোগী সংগঠনের মিছিলে হামাস নেতা খালেদ মাশালকে বিষক্রিয়ার মাধ্যমে হত্যা করতে এজেন্ট পাঠিয়েছিল মোসাদ। পরে তাদের দু’জনকে জর্ডানে আটক করা হয়। তাদের কাছে কানাডার জাল পাসপোর্ট ছিল বলে জানা যায়।
ওই বছরই প্রায় ৭০জন ফিলিস্তিনি মুক্তির বিনিময়ে হামাস নেতা শেখ আহমেদ ইয়াসিনকে তাদের হাতে তুলে দেয়ার জন্য পিএলওকে চাপ দিয়েছিল মোসাদ। এ সময় আহমেদ ইয়াসিন ফিলিস্তিনে বন্দী ছিলেন। এর সাত বছর পর ২০০৪ সালে তিনি যখন মুক্তি পান তখন ইসরাইল হেলিকপ্টার থেকে মিসাইল নিক্ষেপ করে তাকে হত্যা করে।
একই বছর গাড়িবোমায় হত্যা করা হয় হামাসের অপর নেতা ইয ইল-দীন শেখ খলিলকে।
২০০৬ সালে লেটারবোমা পাঠানো হয় দ্য পপুলার ফ্রন্ট ফর দ্য লিবারেশন অব প্যালেস্টাইন নেতা বাসাম আবু শরীফকে।
১৯৭৩ সালের ৯ এপ্রিল রাতে ও ১০ এপ্রিল ভোরে লেবাননে বিমান হামলা চালায়। একই সময় ইসরাইল ডিফেন্স ফোর্সের স্পেশাল ফোর্স ইউনিট বৈরুত, সিডন ও লেবাননে পিএলও’র টার্গেটকৃত নেতাদের খুঁজছিল ও সম্ভাব্য স্থানে হামলা করছিল। এই অপারেশনের নাম দেয়া হয়েছিল অপারেশন স্প্রিং অব ইয়ুথ।
১৯১৪ সালে ইউরোপে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ইহুদিদের স্বপ্ন বাস্তবায়নের এক অপূর্ব সুযোগ সৃষ্টি হয়। ইহুদিরা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অটোম্যান সাম্রাজ্যের পতনের পর ফিলিস্তিনে ইহুদিদের আবাসভূমি স্থাপনের ব্যাপারে মিত্রপক্ষের অঙ্গীকার চাচ্ছিল। ব্রিটেন প্রথমে তাদের উগান্ডায় বসতি স্থাপনের প্রস্তাব দিলেও তারা ফিলিস্তিন ছাড়া অন্য কোথাও যেতে অস্বীকৃতি জানায়। এদিকে ইহুদি বিজ্ঞানী ড. ওয়াইজম্যান কৃত্রিম উপায়ে এসেটিলিন আবিষ্কার করে ব্রিটেনের মন জয় করে নেয়। তাই ১৯১৭ সালের ২ নভেম্বর বেলফোর ঘোষণার মাধ্যমে ইহুদিদের জন্য ফিলিস্তিনে আবাসভূমি প্রতিষ্ঠা করা হয়। কিন্তু, দেখুন সেই ইহুদীরাই আজ ব্রিটেন থেকে আমেরিকাকে বেশি প্রাধান্য দেয়। আবাসভূমি প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ইহুদিরা শুরু করে আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা। এই চেষ্টারই সামান্য কিছু অংশ আজকের ভিডিওতে তুলে ধরলাম। মোসাদের কার্যক্রম যেখানে সরাসরি করা সম্ভব নয়, সেখানে তারা আমেরিকার গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ’র মাধ্যমে তাদের উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের চেষ্টা চালায়। সিআইএ মোসাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে যেতে চাইলেও খুব কমই তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাজ করতে পেরেছে।
বিশ্বের প্রভাবশালী পত্রিকা ও নিউজ এজেন্সিগুলো ইহুদিদের নিয়ন্ত্রণে থাকায় মোসাদের অপকর্ম সাধারণত গণমাধ্যমে আসে না। আমি এই ভিডিওটি তৈরী করতে গিয়ে, যেসব সোর্সের সাহায্য নিয়েছি সেসব নিউজ মিডিয়াগুলোতেও মোসাদের হত্যাকান্ডের শিকার হওয়া লোকেদেরকে টেরোরিস্ট বলেই সম্বোধন করা হয়েছে বিশেষ করে হামাসের নেতা কর্মীদেরকে যেখানে হামাস কিনা ফিলিস্তিনের একটি স্বাধীনতাকামী সংঘঠন। অর্থাৎ, ইসরাইল ও আমেরিকা বিরোধী যে কাউকে তারা সরাসরি সন্ত্রাস আখ্যা দিতে ২য় বার চিন্তা করে না।