টম এন্ড জেরির অজানা ইতিহাস
টম এন্ড জেরি কার্টুনের নাম শুনেনি বর্তমান সময়ে এরকম মানুষ খুজে পাওয়া কিন্তু খুবই মুশকিল। ছেলে বুড়ো সব বয়সের মানুষের কাছে খুব পরিচিত একটি কার্টুন ‘টম এন্ড জেরি’। বিড়াল ইঁদুরের বাস্তবিক শত্রুভাবাপন্ন সম্পর্কের কথা কিন্তু আমরা সবাই জানি। উইলাম হানা এবং জোসেফ বারবারা বিড়াল ইঁদুরের এই সম্পর্কটাকে কখনো মধুর আবার কখনো মারামারি, কাটাকাটি ও নানা রকম দুষ্টুমির মাধ্যমে উপস্থাপন করেছেন ‘টম এন্ড জেরি’ কার্টুনের মধ্যদিয়ে।
টম এন্ড জেরি’ কার্টুনে টম হল একটি নিলাভ ধূসর ছাই রঙয়ের বিড়াল এবং জেরি হল বাদামী রঙয়ের একটি ইঁদুর যে একই বাড়ীতে টমের সাথেই থাকে। সারাক্ষণ দুজনের মধ্যে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে মারামারি চলতেই থাকে। অনেক সময় টম জিতে যায়, আবার অনেক সময় জেরি জিতে যায়। কার্টুনটিতে দেখা যায় টম একটু বোকা স্বভাবের আবার অন্যদিকে জেরি প্রকান্ড চালাক ও দুষ্টু প্রকৃতির। টমের সাথে জেরির মানসিকতার কোনই মিল নেই। তবুও কখনো কখনো বিশেষ করে ক্রিসমাসের সময় একে অপরের জীবন বাঁচাতে বা উপহার আদান প্রদান করতেও দেখা যায়। মাঝে মাঝে আপনার এই দুজনের দৈনন্দিন ছোটাছুটিকে ওদের রুটিনমাফিক খেলা বলেই মনে হবে। আর এই দুই চরিত্রকে কেন্দ্র করে উইলিয়াম হানা এবং জোসেফ বারবারা, ‘মেট্রো-গোল্ডউইন মেয়ার’ স্টুডিও থেকে ১৯৪০ সালে সর্বপ্রথম ‘পুস গেটস দ্য বুট’ নামে টম এন্ড জেরির প্রথম পর্ব প্রকাশ করেন। তখন টম বিড়ালের নাম ছিল জ্যাসপার এবং জেরি ইঁদুরের নাম ছিল জিঙ্কস। এরপর ধীরে ধীরে বিভিন্ন পর্ব প্রচারিত হতে থাকে। শুরুতে উইলিয়াম হানা এবং জোসেফ বারবারা ১৯৪০ সাল থেকে ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত এম.জি.এম কার্টুন স্টুডিও (Metro-Goldwyn Mayer –‘MGM’ Cartoon Studio) থেকে বেশ কিছু পর্ব প্রচারিত করেন।
এ সময়ের মাঝে তারা আর্থিক টানাপোড়নের মধ্যে সময় অতিবাহিত করতে থাকেন এবং এভাবে চলে যায় বেশ কিছু বছর। এরপর তারা দুজন ১৯৭৫ সালের দিকে আবার টম এন্ড জেরি কার্টুন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন।
তাদের নতুন করে আবার কাজ শুরু করার পূর্বে অর্থাৎ ১৯৫৮ সাল থেকে ১৯৭৪ সালের মধ্যে ‘টম এন্ড জেরি’ নিয়ে কাজ করেন জেনে ডিচ এবং চাক জোন্স। আর এই কারনেই আমরা টম এন্ড জেরি কার্টুনে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পরিবর্তন দেখতে পাই। অর্থাৎ টম ও জেরির অংকন চিত্রে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পরিবর্তন দেখতে পাই। যেমন প্রথম দিকের টমের চেহারা যেমনটা ছিল বর্তমানে টমের চেহারা বা শারিরিক অবয়বে কিছুটা পার্থক্য রয়েছে। তবে সেই অংকন যেই আকুক না কেন… যেমনই আকুক না কেন, খুশির জগতে কিন্তু এখনো সকলের মন জয় করে চলেছে টম এন্ড জেরি।
যদিও টম বেড়াল ও জেরি ইঁদুরই টম এন্ড জেরি কার্টুনের প্রধান চরিত্র, তবুও আমরা মাঝে মাঝে কিন্তু কিছু মজার মজার চরিত্রের দেখা পাই কার্টুনটিতে। জেরিকে ধরতে কখনো কখনো টমকে অনাকাঙ্খিত চরিত্রের সাহায্য নিতে হয়। এমনি এক চরিত্র হল বাচ। বাচ হল গলিতে থাকা কালো রঙের নোংরা এক বিড়াল যে নিজেও জেরিকে ধরে খেতে চায়। আরও কিছু চরিত্র হল স্পাইক, রাগী ভয়ংকর দারোয়ান বুলডগ যে বিড়ালদের পিটাতে খুব পছন্দ করে এবং ম্যামী-টু-শুস্ - একজন আফ্রিকান আমেরিকান চরিত্র ,যার চেহারা কখনো দেখা না গেলেও দোষ্টুমি করলে টমের কপালে তার ঝাটাপেটা ঠিকই জোটে।
পঞ্চাশের দশকের শেষের দিকে, জেরি একটি ধূসর রঙের ছোট ইঁদুর দত্তক নেয় যার বর্তমান নাম টাফি বা ট্যারি। টাফি কথা বলতে পারে তবে সাধারণত বিদেশী ভাষায় যাতে করে পর্বের থিম এবং পারিপাশ্বিকতার সাথে সামঞ্জস্য থাকে।
আরেকটি এভিয়ান চরিত্র হল ছোট হলদে পাখি যার প্রথম উপস্থিতি ছিল ১৯৪৭ এর কিটি ফয়েলড এ যা কোয়াকার এর প্রাক্তন রুপ।জেরির অনেক আত্মীয়ও রয়েছে যাদের কেবল ২টি পর্বে দেখা যায়। এদের মধ্যে জেরির কাজিন মাসলসকে দেখা যায় ১৯৫১ সালে প্রচারিত হওয়া জেরিস কাজিন পর্বটিতে এবং জেরির মামা পেকোসকে দেখা যায় ১৯৫৫ সালে প্রচারিত হওয়া পেকোস পেস্ট নামক পর্বটিতে।
এবার চলুন জেনে নেয়া যাক টম এন্ড জেরীর পর্দার আড়ালে থাকা কিছু অজানা ফ্যাক্ট সম্পর্কে।
ফ্যাক্ট নাম্বার ১
টম এন্ড জেরির বয়স কিন্তু ৮০বছরের উপরে। সে হিসেবে টম এন্ড জেরিকে আমাদের দাদা হিসেবে মানতেই হবে।
ফ্যাক্ট নাম্বার ২
গোড়ার দিকে টম এন্ড জেরির একটি পর্ব বানাতে প্রায় ২৬হাজার ড্রয়িংয়ের প্রয়োজন হতো। পরবর্তীতে এ ড্রয়িংয়ের পরিমাণ কমে ষোলশো তে নেমে আসে।
ফ্যাক্ট নাম্বার ৩
খরচের দিকটা লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, পঞ্চাশের দশকে টম এন্ড জেরির ৭মিনিটের একটি কার্টুন বানাতে খরচ হতো প্রায় ছত্রিশ হাজার ডলার। পরবর্তীতে হ্যানা ও বারবারার কার্টুন বানানোর নতুন পদ্ধতি “সেমি এনিমেশন” আবিষ্কারের ফলে এ খরচের পরিমান নেমে আসে তিন হাজার ডলারে।
ফ্যাক্ট নাম্বার ৪
১৯৪০-১৯৫২ সাল পর্যন্ত এ কার্টুনটি সাতবার অস্কার জয় করেছে এবং যা কার্টুনটিকে ইতিহাসে সর্বাধিকবার অস্কারজয়ী কার্টুনের খেতাব লাভ করার সুযোগ করে দেয়।
ফ্যাক্ট নাম্বার ৫
জেরিকে প্রথম থেকেই বুদ্ধিমান হিসেবে দেখানো হলেও শুরু দিকে টমের আচরণ, বুদ্ধিমত্তা, চলার ভঙ্গি সাধারন বেড়ালের মতোই ছিল। পরে তার চলাফেরার ভঙ্গি স্থায়ীভাবে মানুষের মতো দু পায়ে করে দেয়া হয়।
ফ্যাক্ট নাম্বার ৬
কার্টুনে টম ও জেরীর লাঠিশোটা, বোমা, পিস্তল, তলোয়ার, কামান, ছুড়ি, চাকুসহ নানান অস্ত্রসস্থ ব্যবহার করে মারামারির মাধ্যমে ভায়োলেন্স সৃষ্টি করার কারনে তৎকালীন সময়ে টম এন্ড জেরী ছিল একটি বিতর্কিত কার্টুন।
ফ্যাক্ট নাম্বার ৭
টম এন্ড জেরি বিতর্কের আরেকটি কারন হচ্ছে টমের মালিক মাম্মি টু শুজ। কার্টুনে যার শুধু পাদুটোই দেখা যায়। কার্টুনে এই মহিলার ডায়লগ ছিল কৃষ্ণাঙ্গদের উচ্চারিত ইংরেজীতে। এটাও বিতর্কের কারন না। বিতর্কের কারন হচ্ছ, ওই মহিলাটির কথাবার্তার মাধ্যমে তাকে খুবই বোকা ও আর ভীতু বোঝানো হতো। সেজন্য কৃষ্ণাঙ্গরা বিতর্ক করে যে, তাদের হেয় করার জন্য এটা ইচ্ছাকৃতভাবে করা হয়েছে। পরে টমের মালিকের ডায়লগগুলো পরিবর্তন করে আইরিশ আমেরিকান উচ্চারনে দেয়া হয়।
ফ্যাক্ট নাম্বার ৮
১৯৪০ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত টম এন্ড জেরি পৃথক পৃথক চারজন পরিচালকের হাতে তৈরী হয়।
এছাড়া বেশ কিছু ফ্যাক্ট আমি লেখাটির মূল অংশেই বলে দিয়েছি।
সবশেষে একটি কথা বলতেই হয়, পৃথিবীতে যত আধুনিক অ্যানিমেশন এর উদ্ভাবন হোক না কেন টম এন্ড জেরী কার্টুনের গ্রহনযোগ্যতা কখনো কোন অংশেই কমবে না। যেমনটা আমাদের বাপ দাদাদের আমলে ছিল ঠিক সেরকমটাই রয়ে যাবে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মেও।